শুনেই কেন জানি না ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। থাকতাম কোচবিহারের শীতলখুচিতে। বছরে একবার সপরিবার বেরোতাম। প্রথমে সোজা জামশেদপুরে বড়মাসির বাড়ি (সেটাকেই চিরকাল মামাবাড়ি হিসেবে চিনে এসেছি)। দশমীর দিন ডাক্তারমামার (মাসির সহকর্মী চিকিৎসক) গাড়িতে যেতাম নদীর তীরে। নিমকি ইত্যাদি নানা খাবার থাকত বড়মাসি আর মনীষা মামীর (ডাক্তারমামার স্ত্রী) ঝোলায়। রাস্তার পাশে সার বেধে বসে শয়ে শয়ে মানুষ। আমরাও বসে থাকতাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সার দিয়ে একের পর এক প্রতিমা যেত বিসর্জনে।
৮ বছর বয়সে আমরা পাকপাকি ভাবে কলকাতায় চলে আসি। বাবা মা দিদির সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যেতাম। আমার ছোটবেলায় এত রকম প্যান্ডেল, প্রতিমা ছিল না। ভবানীপুর, কালীঘাটের কিছু পুজো ছিল বিখ্যাত। আর ছিল কলেজ স্কোয়ার, মহম্মদ আলি পার্ক। তবে এতো বৈচিত্র ছিল না।
কলেজে ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর থেকে পুজো মানেই বুকস্টল। সেখানেই পুরো পুজোটা কেটে যেত। তখন ভাবতাম, বাম রাজনীতির লোকেদের পুজো ওভাবেই কাটান উচিত। বামফ্রন্ট তখন ক্ষমতায়। আমি ছিলাম সেই আন্দোলনের অংশ। কিন্তু দুনিয়ার সবচেয়ে বড় রাস্তার উৎসবের সময় ব্যস্ত থাকতাম বুকস্টলে বা রাস্তায় কৌটো ঝাঁকিয়ে টাকা তোলায়। থাকতাম ছোট একটা গণ্ডিতে আটকে।
বলতে কোনও অসুবিধা নেই, সম্পূর্ণ ভুল ছিল সেই বোঝাপড়া।
রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার পর মিডিয়ার চাকরিতে ঢুকলাম। ধীরে ধীরে দুর্গোৎসবের ব্যাপ্তি অনুভব করা শুরু করলাম। তখন থেকেই একটা ভাবনা মাথায় ঘুরত, এতো বড় সৃষ্টির উৎসবের বিপণন বড় দুর্বল। কোনও পরিকল্পনা নেই। সব স্বতস্ফূর্ততার ওপর ছেড়ে দেওয়া। আনন্দবাজারে চাকরি করার সময় চিফ রিপোর্টার দেবদূত ঘোষ ঠাকুর ছিলেন দুর্গোৎসবের অনুরক্ত সঙ্গী। তাঁর কাছ থেকে এই উৎসবের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সম্পর্কে নানা রকম ধারণা পেয়েছি। তারপর ভবতোষ সুতার।
পুজোর সময় প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরতে বেশ লাগে (ভিড়টা খানিক কষ্টকর)। কত রকম ভাবনা! কত রকম সৃষ্টি! কত মানুষ! কত দৃশ্য! কত প্রতিক্রিয়া! ছোটবেলা থেকেই ঘুরি।
ধীরে ধীরে পুজোর চেহারাটা বদলাতে থাকে। বিভিন্ন কোম্পানি বাণিজ্যিক সম্ভাবনার দিকটা বুঝতে পেরে বিনিয়োগ বাড়াতে থাকে। চাঁদা তুলে পুজোর রেওয়াজ উঠেই যেতে থাকে। বেশ কিছু বড় বাজেটের পুজো মাথা তোলে। পুজো দেখতে মানুষের ঢলও বাড়তে থাকে।
২০১১ সালের পর থেকে সরকারি স্তরে দুর্গোৎসব সম্পর্কে নিরাসক্তি কাটতে থাকে। পুজোর অর্থনীতি নিয়ে সমীক্ষা শুরু হয়। ২০১৩ সালে বণিক সভা Assocham-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে বাংলায় ২৫ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। ২০১৯ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল, খড়্গপুর আইআইটি, ব্রিটেনের কুইন মারি বিশ্ববিদ্যালয় যৌথ রিপোর্ট দেয় সরকারকে। সেই রিপোর্ট প্রকাশ করে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, দুর্গাপুজোয় শৈল্পিক ক্ষেত্রে লেনদেন হয় ৩২ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকার। এটা মলদ্বীপের জিডিপি-র সমান। রাজ্যের জিডিপি-র ২.৫%।
অনেক বছর আগে ১৯৫৪ সালে Economic and Political Weekly 'Economics of the Durga Puja' শিরোনামে উত্তরবঙ্গের বন্যা ও দক্ষিণবঙ্গের খরার প্রেক্ষিতে দুর্গাপুজোর কেনাবেচা নিয়ে কেনাবেচা নিয়ে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর থেকে অনেক কাব্য হয়েছে, অনেক নস্টালজিয়া হয়েছে, 'হাতে হাত ধরি ধরি এসো আমরা সম্প্রীতি করি' হয়েছে, অনেক লেখালেখি হয়েছে, আরও অনেক কিছুই হয়তো হয়েছে, কিন্তু অর্থনীতির হিসেবনিকেষ হয়নি।
দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে আর্থিক লেনদেন মুম্বইয়ের গণেশ চতুর্থীর তিন গুণ। বিভিন্ন দেশের নানা উৎসব নিয়ে খোঁজখবর করতে গিয়ে দেখেছি সৃষ্টির বৈচিত্র, ব্যাপ্তি, মানুষের অংশগ্রহণের বিচারে দুর্গোৎসবই খোলা আকাশের নিচে দুনিয়ার বৃহত্তম উৎসব। কিন্তু ইন্টারনেটে তন্নতন্ন করে খুঁজুন। দুনিয়ার উৎসবের কোনও তালিকাতেই দুর্গোৎসবকে খুঁজে পাবেন না।
সেই অবস্থাটা বদলাতে সরকারি স্তরে প্রথম উদ্যোগ নেন মমতা ব্যানার্জি। দুনিয়ার লোকের চোখ টানতে তাঁর উদ্যোগেই শুরু হয় কার্নিভাল।
বলতে কোনও অসুবিধা নেই, আমাদের মনোভাব যথেষ্ট নেতিবাচক। সমস্ত কিছুকেই রাজনীতি আর পার্টির চশমা পরে দেখাটা আমাদের অভ্যাস। কার্নিভাল নিয়েও বিদ্রুপ, আপত্তি অনেক হয়েছে ও হচ্ছে। সরকারি টাকায় মোচ্ছবের অভিযোগও ওঠে।
বলতে কোনও অসুবিধা নেই, ছক বাঁধা রাস্তায় ভাবতে আমরা বড্ড পছন্দ করি। সরকারি চাকরির শান্তি তাই আমাদের বড় পছন্দ। সরকারি না হলেও বেসরকারি চাকরি হলেও চলবে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে তাই মাথায় তুলে রাখি না। কী অলুক্ষুনে কথা বলেছিলেন তিনি! বাঙালি ব্যবসা কর।
অর্থনীতির উন্নয়ন মানে? মিডিয়া জগতের এক তারকা চরিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার সঙ্গে কথোপকথনে সদম্ভে বললেন, 'যেটা বুঝি তা হল কারখানা চাই, সার্ভিস প্রোভাইডরদের জন্য আইটি হাব চাই আর স্টার্ট আপও চাই। কিন্তু সবার আগে ভারী শিল্প চাই। ওটা দেখেই বাকিরা আসে।'
মানে টাটার গাড়ি কারখানা, জিন্দালের ইস্পাত কারখানা নয়তো দেউচা-পাঁচামির কয়লা। নয়তো ভবিষ্যত ফর্সা?
দুনিয়ার অর্থনীতির দিকে তাকিয়ে দেখুন। অর্থনীতিতে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রের দ্বিগুণেরও বেশি অবদান পরিষেবা ক্ষেত্রের। আমাদের দেশের অর্থনীতিতেও এখন পরিষেবা ক্ষেত্রের অবদান ৫০ শতাংশের বেশি। দুনিয়ার অর্থনীতিতে ১০ শতাংশেরও বেশি অবদান পর্যটন শিল্পের আর ভারতের অর্থনীতির ৬.৮%। ভারতে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান কমছে। বাড়ছে পরিষেবা ক্ষেত্রে। দুনিয়ার অর্থনীতিতেও শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থান কমেছে বা ওঠানামা করেছে। বেড়েছে শুধু পরিষেবা ক্ষেত্রে। তারমধ্যে পর্যটন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের হার ক্রমাগত বাড়ছে।
এই প্রেক্ষিতেই দুর্গোৎসবের অর্থনীতিকে দেখা দরকার। বাড়তে বাড়তে যার আয়তন এখন ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকা। কেউ কেউ দাবি করেন, ১ লক্ষ কোটি টাকা। ইউনেস্কো ইনট্যানজেবল কালচারাল হেরিটেজ (Intangible Cultural Heritage, ঠিকঠাক বাংলা প্রতিশব্দ আমার জানা নেই। ছোঁয়া যায় না এমন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য) স্বীকৃতি পাওয়ার পর সে সম্ভাবনা আরও বেড়েছে। কিন্তু ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিলেই তো হবে না, তাকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা চাই। ২০১০ সালে ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি পেয়েছে আমাদের ছৌ নাচ। তাতে কাজের কাজ হয়েছে কতটা?
মমতা ব্যানার্জি শারদোৎসবকে আন্তর্জাতিক চেহারা দিতে উদ্যোগী হয়েছেন, সেটা ঠিক। আবার মমতা ব্যানার্জি থাকলে এই সম্ভাবনার ছিঁটেফোঁটাও বাস্তবায়িত হবে না বলেই আমি মনে করি। কারণ তাঁর মনোভাব। তিনি সব বোঝেন, জানেন এবং করেন-এই মনোভাব। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির ব্যাপারটাই দেখুন। তিনি বেমালুম বোঝাতে লাগলেন, তাঁর জন্যই এই স্বীকৃতি এসেছে। কেন্দ্রীয় সরকারও তেমন। তারাও বোঝাতে লাগল, স্বীকৃতি তাদের জন্যই। এবছর কেউ কেউ হঠাৎ বলা শুরু করলেন, গবেষক তপতী গুহ ঠাকুরতার জন্য এই স্বীকৃতি। বাস্তবে ২০০৮ সাল থেকে ইউনেস্কো এই স্বীকৃতি দিচ্ছে। তার নোডাল এজেন্সি কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক। দুর্গাপুজো নিয়ে গবেষণার ভার কেন্দ্রীয় সরকারই তপতীদেবীকে দিয়েছিল। রাজ্য সরকারও উদ্যোগী হয়েছিল। ওই গবেষণা, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চেষ্টাতেই এই স্বীকৃতি। সবাই মিলে এগোতে না পারলে সম্ভাবনার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
মমতা একের পর এক পুজো উদ্বোধন করেন। সেখানে অংবংচং বকে যান। স্তাবকেরা হাসে, হাততালি দেয়। কিন্তু উৎসব তার নিজস্ব গরিমা হারায়। তাতে অর্থনীতির ক্ষতি হয়। অথচ এই উৎসব আমাদের রাজ্যের অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারে। শুধু উৎসবের কয়েকটা দিনই নয়, সারা বছর ধরে তার খির খেতে পারি আমরা।
এক সময় সরকার শারদোৎসব সম্পর্কে নিস্পৃহ ছিল। আর এখনকার সরকার, বলা ভাল মুখ্যমন্ত্রী সম্পূর্ণ রাশটা নিজের হাতে রাখতেই মরিয়া। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভোটের অঙ্ক। কোভিডের সময় বছর দুই ক্লাবগুলোকে অনুদান দেওয়ার তাও একটা অর্থ যদিবা থাকে, কিন্তু এবছর? অর্থহীন কাজ। পুজো অর্থনীতিতে সরকার ২৬০ কোটি টাকা ঢোকাতে চাইলে ঢোকাক। কিন্তু ক্লাবগুলোকে দিয়ে লাভ কি? ওটা উৎসবেরই অন্য কাজে লাগালে অর্থনীতির লাভ হতো। কিন্তু তাতে তো ক্লাবগুলোকে হাতে রাখা যেত না। ভোটের অঙ্কে ক্ষতি হতো।
একটা বড় পুজো সুজিত বসুর শ্রীভূমি। প্রবল ভিড় হয়। গত বছর লেজার রে লাগাল। বিমানবন্দরের এতো কাছে লেজার রে লাগালে পাইলটদের যে মাথা খারাপ হয়ে যাবে, সেটা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধি লাগে না। সুজিত ওখানে ভিআইপি রোডের পাশের সব নয়ানজুলি বুঝিয়ে দিয়েছেন। সেগুলো থাকলে ওই পুজো করা যেত না। পরিবেশ আদালত নয়ানজুলি ফেরাতে বলেছে। কে কান দেয় তাতে? তারপর ঘুরপাক খেতে খেতে ঘুপচি জায়গায় প্যান্ডেল। আচমকা কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে? দমকলমন্ত্রীর পুজোয় দমকল ঢোকার রাস্তা আছে তো? হোক শ্রীভূমির পুজো। নয়ানজুলি ফিরিয়ে দিয়ে, খোলামেলা জায়গায় হোক পুজো।
(পরের পর্বে শারদোৎসবের অর্থনীতির সম্ভাবনা সম্পর্কে আমার মতামত জানাব। এই লেখাটি কেমন লাগল সেটা নিচে কমেন্ট বক্সে লিখলে বা ইমেল করে জানালে খুশি হব।)